Harmony

হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও নিরাময়ে করণীয়

July 28, 2022

বিশ্বে প্রায় প্রতি ২০ সেকেন্ডে ১ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন হেপাটাইটিস জনিত কারণে! দেশের এক কোটি মানুষ বহন করছেন হেপাটাইটিস বি’ কিংবা ‘সি’ ভাইরাস। এদের প্রতি ১০ জনের ৯ জন-ই জানেন না নিজেদের বিপন্নতার কথা! ফলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিজের অজান্তে। লক্ষণীয় যে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের এবং নারীর চেয়ে পুরুষের ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্তের প্রবণতা  বেশি। অথচ শুধু সামান্য সচেতনতা ও কিছু সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব এ মৃত্যুদূত-কে।

হেপাটাইটিস কি?

হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ (Inflammation) সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। লিভার দেহের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। খাদ্য, পানীয় এবং মুখে গ্রহণ করা ঔষধ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সেগুলোকে অন্যান্য অঙ্গে সরবরাহ করা লিভারের মূল কাজগুলোর একটি। শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকায় থাকে লিভার। দেহের সাপেক্ষে একে তুলনা করতে পারেন একই সাথে Power House এবং Sewage Treatment Plant হিসেবে!

খাদ্য, পানীয়, বা ওষুধের মাধ্যমে রক্তে মিশে যাওয়া ক্ষতিকারক উপাদানের সংস্পর্শ, কিংবা দেহের বাইরে থেকে আসা ভাইরাসের মত অণুজীবের আক্রমণে মাঝে মাঝে নিজেই বিপন্ন হয়ে পড়ে লিভার। ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার কোষ -দেখা দেয় হেপাটাইটিস! ক্রণিক হেপাটাইটিসে লিভারের কর্মক্ষমতা কমে যায়। এমনকি কখনো কখনো লিভার পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এছাড়াও থাকে লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারের আশংকা। এটা মনে রাখা ভালো যে লিভারের কোন জটিল সমস্যার চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যায়বহুল, দেশে লিভার বিশেষজ্ঞের সংখ্যা মাত্র শ-খানেক, এবং লিভার প্রতিস্থাপনের সুযোগ সেভাবে আমাদের দেশে নেই।

কারণ ও প্রতিরোধ

আসুন জেনে নেয়া যাক কীভাবে রোগটি হয়। ভাইরাসের সংক্রমণ, অ্যালকোহল, ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ এবং অটো ইমিউন রোগ ইত্যাদি নানা কারণে আপনি আক্রান্ত হতে পারেন হেপাটাইটিসে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী হেপাটাইটিসে আক্রান্ত  হন ভাইরাস জনিত কারণে। এ পর্যন্ত পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে – এ, বি, সি, ডি এবং ই। তবে এগুলো ছাড়াও আরও হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। হেপাটাইটিস এ এবং ই  উভয়-ই খাদ্য ও পানিবাহিত ভাইরাস। তবে অত্যন্ত সংক্রামক হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে সংক্রমিত হতে পারেন যে কেউ। হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসের নির্ভরযোগ্য  টিকা বাজারে সহজলভ্য। তবে হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাসের  টিকা ২০১২ সাল থেকে চীনে প্রচলিত হলেও অন্যত্র এর প্রচলন খুব বেশি নেই। এ দুটি ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে  টিকা নেবার পাশাপাশি কাঁচা খাবার ও তাজা ফলমূল বা শাক-সবজি গ্রহণেও সাবধানতা প্রয়োজন।  খাদ্য ও পানি দুটোই নিরাপদ হতে হবে। শুধু পান করার জন্য নয়, প্লেট বা কাঁচা খাবার ধোয়ায় ব্যবহৃত পানিটিও নিরাপদ হতে হবে।

হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ভাইরাস  রক্তবাহিত। বি ও সি সংক্রমিত হতে পারে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও। উল্লেখ্য যে, লিভার সেলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের উপস্থিতি ছাড়া হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস ছড়াতে পারে না। তবে  হেপাটাইটিস ডি ভাইরাসের সাহায্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এছাড়াও হেপাটাইটিসে আক্রান্ত নারীর গর্ভস্থ সন্তানেরও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের  টিকা প্রথম প্রচলিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮১ সালে। অত্যন্ত কার্যকর এই  টিকা ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশে জাতীয় টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা নেয়ার পাশাপাশি বি সি ও ডি ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন এড়িয়ে চলতে হবে। অস্ত্রোপচার, ডায়ালাইসিস, রক্ত বা রক্তের উপাদান নেয়ার আগে টেস্ট করিয়ে নেয়া দরকার। একই সূঁচ একাধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার করা যাবে না অন্যের ব্যবহৃত রেজার বা টুথব্রাশ। এছাড়াও পরিহার করতে হবে অনিরাপদ ও অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক ।

ভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়াও আরো নানা কারণে হেপাটাইটিস হতে পারে। দীর্ঘদিন অপরিমিত  মদ্যপানের ফলে হেপাটাইটিসের ঝুঁকির কথা প্রায় সবার-ই জানা। তবে অনেকের-ই হয়তো জানা নেই যে দীর্ঘ সময় ধরে কিছু ঔষধের উচ্চমাত্রায় ব্যবহারের ফলেও হতে পারে রোগটি। এমন ঔষধের মধ্যে রয়েছে Acetaminophen  সমৃদ্ধ জ্বর ও ব্যথা কমানোর ঔষধ, Sulfa Medicines জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক, Statins জাতীয় কোলস্টেরল কমানোর ঔষধ, জন্মনিরোধক ট্যাবলেট, Aspirin, Non-steroidal anti-inflammatory Medicines, Anabolic Steroids এবং মৃগী রোগের ওষুধ ইত্যাদি। এছাড়া Ephedra, Germander, ও Pennyroyal সহ আরো কিছু হারবাল ওষূধও রয়েছে এ তালিকায়।

Type 1 Diabetes, Thyroiditis, Hemolytic Anemia, Immune Thrombocytopenia, Ulcerative Colitis, Celiac Disease, Grave’s disease জাতীয় Autoimmune Disease এর প্রভাবেও আপনি আক্রান্ত হতে পারেন হেপাটাইটিসে। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা প্রায়ই এমন কিছু বিষাক্ত দ্রব্যের সংস্পর্শে আসি, যেগুলো থেকেও হেপাটাইটিস হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ এমন উপাদানের মধ্যে রয়েছে Dry Cleaning এ ব্যবহৃত কার্বন টেট্রা ক্লোরাইড, প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত Vinyl Chloride, Paraquat জাতীয় আগাছানাশক, Polychlorinated Biphenyls গ্রুপ এর কোন রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি।

কাজেই এটা পরিষ্কার যে শুধু ভাইরাস ঠেকালেই চলবেনা, হেপাটাইটিস প্রতিরোধে সতর্ক থাকতে হবে অসংক্রামক কারণগুলির ক্ষেত্রেও। অ্যালকোহলের মতই সতর্ক থাকতে হবে ওষুধের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। এড়িয়ে চলতে হবে বিপদজনক রাসায়নিক পদার্থ। বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে তাদের, যারা বহুদিন ধরে ভুগছেন অটোইমিউন রোগে। নিয়মিত বিরতিতে হেপাটাইটিস টেস্ট করাতে হবে। আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক পরামর্শ করতে হবে চিকিৎসকের সাথে।

লিভার সুরক্ষার প্রাকৃতিক উপায়

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করা নিয়ে। দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিরক্ষা কৌশল রয়েছে। সেটি হল প্রাকৃ্তিক উপায়ে লিভারের পরিচর্যা করা। একে শক্তিশালী করে তোলা। এ কৌশল শুধু হেপাটাইটিস প্রতিরোধ নয়, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাতেও পরিপূরক ভূমিকা রাখবে। আর এর পুরোটাই রয়েছে আপনার নিজের হাতে।

লিভার-কে শক্তিশালী করার প্রাথমিক ধাপটি পুরোপুরি রান্নাঘর নির্ভর। আদা, হলুদ ও রসুন এই ৩টি উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে ও পদ্ধতিতে নিয়মিত গ্রহণ করলে লিভার ভালো থাকে। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের বিষয়টিও লিভার-কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অনেকের-ই খুব প্রিয় কিছু খাবার রয়েছে যা লিভারের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো বাদ দেয়া উচিত। ক্ষতিকর খাবারের তালিকায় রয়েছে সাদা আটা/ময়দা/চাল এবং সাদা চিনির মত রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট; রেড মীট, কিংবা প্রসেসড মীট; ফাস্ট ফুড, পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ (whole milk), চীজ বা আইস-ক্রিম এর মত উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার; এবং প্যাকেট করা বা প্রক্রিয়াজাত খাবারের মত উচ্চ মাত্রার লবণযুক্ত খাবার।

একইভাবে এমন কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো লিভারের জন্য ভালো। সাধারণভাবে যে কোন প্রাণিজ আমিষের চেয়ে উদ্ভিজ্জ আমিষ লিভার বেশি পছন্দ করে। গবেষণায় দেখা গেছে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় শাক-সবজির পরিমাণ ১০০ গ্রাম বাড়ালে তা শতকরা ৮ ভাগ পর্যন্ত হেপাটাইটিসের ঝুঁকি কমাতে পারে। ফলের মধ্যে লেবু জাতীয় টক ফল, আপেল, আঙ্গুর ও পেঁপে লিভারের জন্য উপকারি। একই কথা প্রযোজ্য গাজর, টমেটো, বিটরুট, লাল বাঁধাকপি, ও সবুজ শাক সবজির ক্ষেত্রে। বাদাম, ওটস্, এবং অলিভ অয়েল এর ব্যবহার লিভারকে ভালো রাখে। প্রাণিজ আমিষের মধ্যে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ উপকারী। গ্রীন-টি এবং কফি এ দুটোই লিভারের পক্ষে উপকারি। লিভার-কে ভালো রাখতে গেলে অবশ্যই প্রচুর পানি পান করতে হবে।

এতক্ষণ তো গেল খাবারের কথা। এবারে আসা যাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃ্ত দুটি মেথডের প্রসঙ্গে। এগুলো হল যোগ ও রিফ্লেক্সোলজি থেরাপি। দুটোতেই রয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে লিভারের যত্ন নেয়ার সুযোগ। উপযুক্ত প্রশিক্ষকের কাছে শিখে নিয়ে খুব সহজেই এগুলোর চর্চা করা যায়। নিয়মিত অভ্যাস ভালো রাখবে আপনার লিভারকে। এগুলোর চর্চা হেপাটাইটিসসহ যে কোন রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে (চিকিৎসার পাশাপাশি) সাহায্য করে।

২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের প্রতিজ্ঞা নিয়েছে বিশ্ব। এই প্রতিজ্ঞা পূরণে সবার সচেতনতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব অন্যদের সচেতন করে তোলা। শুধু চিকিৎসকের উপর নির্ভরতা আমাদের রক্ষা করবে না। নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে পারি কেবলমাত্র আমরা নিজেরাই!

অমিতাভ ভট্টাচার্য্য

স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মী

Ceo.harmony19@gmail.com

Facebook
Twitter
LinkedIn