Harmony

মাতৃদুগ্ধ পান শিশুর অধিকার, মায়ের জন্য হিতকর

August 6, 2022

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, জন্মের প্রথম ৬ মাস যেকোনো শিশু শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। অথচ বিশ্বে মাত্র ৪৪% শিশু এ সুযোগ পায়। (আল জাজিরা, ২০২২)

বিশ্বব্যাপী বছরে লাখো শিশুমৃত্যু ঘটছে মাতৃদুগ্ধ পান না করতে পারার কারণে! এদিকে প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়সী ৪৫% শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যায়। (The Lancet Medical Journal, 2013) এই অপুষ্টি প্রতিরোধ করার অন্যতম উপায় হচ্ছে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো। মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে বিশ্বজুড়ে শিশুমৃত্যুহার কমানো সম্ভব, এবং সে সাথে ক্যান্সার এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণে বছরে হাজারের বেশি মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকিও কমানো সম্ভব।


কেন শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে?

শিশুর জন্মের পরপর মায়ের বুকের শাল দুধ তার জন্য অতি জরুরি। এই শাল দুধ শিশুর পুষ্টি চাহিদা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিশ্চিত করে। শিশুর জন্মের পর থেকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত তাকে শুধু বুকের দুধ দিতে হবে। এবং অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি বুকের দুধ দেয়া উচিত। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য যেমন পুষ্টির খোরাক, তেমনি পাশাপাশি মায়ের জন্যও বুকের দুধ পান করানোর অনেক উপকারিতা আছে।

বুকের দুধ শিশুর জন্য যেসব ক্ষেত্রে উপকারীঃ

  • মায়ের বুকের দুধ খাঁটি, রোগজীবাণু বিহীন, শিশুর জন্য নিরাপদ এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিতে পরিপূর্ণ।
  • বুকের দুধ শিশুর জন্য সহজপাচ্য, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য বা বদহজম হয় না।
  • বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের ভবিষ্যতে কতগুলো সমস্যার ঝুঁকি কমে, যেমন – স্থূলতা(obesity) , ডায়াবেটিস, SIDS.
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানে ইনফেকশন হওয়া প্রতিরোধ করে।
  • শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ভালো হয়।
  • নানারকম এলার্জির আশঙ্কা কমে। সেই সাথে এজমা এবং শ্বাসরোগের ঝুঁকি কমে।
  • শিশুর চোয়াল সুগঠিত হয়, এবং ভবিষ্যতে দাঁতের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। (কারণ বুকের দুধ টেনে খাওয়া শিশুর জন্য পরিশ্রমের কাজ, ফলে শিশুর চোয়াল এবং মাড়ির এক্সারসাইজ হয়।)
  • শিশুর মায়ের সাথে বন্ধন দৃঢ় হয়।

বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের জন্য যেসব কারণে উপকারীঃ

  • প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ কম হয়, জরায়ু দ্রুত স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসে। 
  • ওভারিয়ান এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমে। 
  • টাইপ ২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ ঝুঁকি কমে। 
  • শরীরের মেদ কমাতে সাহায্য করে। 
  • শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ান যেসব মায়েরা, তাদের এ সময়ে গর্ভধারণের সম্ভাবনা কম থাকে। 
  • শিশু যখন বুকের দুধ টানে, মায়ের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে তখন প্রোল্যাক্টিন এবং অক্সিটোসিন নামক হরমোন নিঃসরণ হয়। প্রোল্যাক্টিন হরমোন নিঃসরণের কারণে মা রিল্যাক্স ফিল করেন, মা নির্বিঘ্নে বিশ্রাম নিতে পারে। এদিকে অক্সিটোসিন হরমোন মন শান্ত রাখে, স্ট্রেস দূর করে। এছাড়াও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে আরও কিছু হরমোনের নিঃসরণ ঘটে যা মাসিক বিলম্বিত করে এবং নতুন করে গর্ভধারণ বিলম্বিত করে। 

বুকের দুধ খাওয়ানো সমাজের জন্য যেসব কারণে উপকারীঃ

  • বুকের দুধ খাওয়াতে কোন waste তৈরি হয় না, দূষণ হয় না, তাই এটি পরিবেশ বান্ধব। 
  • বুকের দুধ খাওয়াতে কোন খরচ নেই, ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক। 

 

শিশুরা কেন বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়? এবং কীভাবে শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করা যায়?

মা ও শিশু উভয়ের জন্য বুকের দুধের এতো উপকারিতা সত্ত্বেও অনেক মাই নানা সমস্যার কারণে শিশুর বুকের দুধের চাহিদা মেটাতে পারেন না৷ শিশুর মাতৃদুগ্ধ পানের নিশ্চয়তা মায়ের একার দায়িত্ব নয়। পুরো পরিবারের দায়িত্ব, এবং এক্ষেত্রে সমাজেরও অনেকটা দায়িত্ব আছে বৈকি।

শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চয়তার পথে যেসব কারণ বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং এগুলোর সমাধানঃ

  • মায়ের পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পুষ্টিকর খাবার না পাওয়াঃ আমাদের সামাজিক অবস্থায়, মায়েদের সব সামলাতে হয়, ঘরে এবং বাইরে। মায়েদেরকে এই দশভুজা হিসেবে দেখাটা বন্ধ করতে হবে। তারাও মানুষ, তাদেরও সহযোগিতা দরকার হয়। একজন ব্রেস্টফিডিং মায়ের দুধের প্রবাহ ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। সে সাথে নিশ্চিত করতে হবে ব্রেস্টফিডিং মা যেন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পায়। তাই এক্ষেত্রে মায়েদের সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার তা হল, সঙ্গী এবং পরবারের সদস্যদের সহযোগিতা। প্রসূতি মা যখন ডাক্তারের কাছে যান, ডাক্তারের উচিত ফ্যামিলি কাউন্সিলিং, কিংবা অন্তত কাপল কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা, যাতে মায়ের মানসিক এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ রাখতে সঙ্গী এবং পরিবারের লোকজনকে আগ্রহী করে তোলা যায়। মনে রাখতে হবে, সুস্থ মা মানে সুস্থ শিশু।
  • মানসিক চাপ/স্ট্রেসঃ মা কোন শারীরিক/মানসিক কষ্টে থাকলে, স্ট্রেসে থাকলে, অক্সিটোসিন হরমোনের কাজে বাধা সৃষ্টি হয়, ফলে দুধের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। আবার মা যদি মানসিকভাবে সুস্থ থাকে, হাসিখুশি থাকে এবং বাচ্চাকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ায়, তবে দুধের প্রবাহ ঠিক থাকে। তাই স্ট্রেস কমাতে প্রয়োজনীয় বিশ্রামের পাশাপাশি যোগচর্চা করতে হবে।
  • কর্মজীবী মায়েদের কর্ম ক্ষেত্রে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সুযোগের অভাবঃ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, বেশিরভাগ কর্মজীবি মায়েদেরই বাইরের কাজের সাথে বাড়ির কাজও সামলাতে হয়। আবার অনেক মায়ের ওপর থাকে অর্থনৈতিক চাপ। এদেশের কর্মক্ষেত্রগুলোতে ডে কেয়ারের ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত৷ ডে কেয়ারের ব্যবস্থা না থাকায়, অনেক মা কাজে ফিরে যেতে ভরসা পান না। আবার অনেকের ক্ষেত্রে কাজে ফিরে যেতে হলে শিশুকে মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হতে হয়৷ তাই সরকারি এবং বেসরকারিভাবে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। সে সাথে সরকারি কর্ম প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ৬ মাস বেতনসহ মাতৃকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক করার আইন করা উচিত৷
  • শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক উপায় সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাবঃ বুকের দুধ খাওয়ানো একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও, এর প্রক্রিয়া সবসময় সহজ হয় না। অনেক মায়েরাই জানেন না শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম। ভুল পজিশনিং এর কারণে অনেক মা বুকের দুধ খাওয়াতে গিয়ে ব্যথা পান, শিশু ঠিকমতো দুধ পায় না। আবার আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে ভুল তথ্য পেয়ে অনেক মাই হতাশায় ভোগেন। তাই হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলোতে মায়েদের জন্য ফ্রী ব্রেস্টফিডিং কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা থাকা অতি জরুরি।
  • শিশু কিংবা মায়ের শারীরিক অসুস্থতাঃ মায়ের নানারকম শারীরিক সমস্যার (যেমন, থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাজনিত রোগ, Hashimoto’s thyroiditis) কারণে মায়ের বুকে দুধ কম আসে, বা তৈরিই হয় না। আবার কিছু শিশু ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্ট হয়ে থাকে, যার কারণে বুকের দুধের ল্যাকটোজ তাদের পক্ষে হজম করা সম্ভব হয় না। এসব ক্ষেত্রে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে উপদেশ দেন ডাক্তাররা।
  • পাব্লিক প্লেসগুলোতে পর্যাপ্ত ব্রেস্টফিডিং এর ব্যবস্থা না থাকাঃ হাসপাতাল, শপিং মল, সুপার শপ, রেস্টুরেন্ট গুলোতে ব্রেস্টফিডিং এর জন্য ব্রেস্টফিডিং রুম থাকা প্রয়োজন।

 

বুকের দুধ বাড়ানোর উপায় কী?

মায়ের বুকে দুধ যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে আসে, সেজন্য করণীয়ঃ

  • মাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
  • বাচ্চাকে দিয়ে বারবার দুধ টানাতে হবে।
  • পানি এবং তরল জাতীয় খাবার (যেমন স্যুপ, ফলের রস) বেশি খেতে হবে।
  • মাকে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে। 

 

মাতৃদুগ্ধ পানের ক্ষেত্রে যোগচর্চা কিভাবে সাহায্য করতে পারে?

যোগচর্চা যেহেতু একটি লাইফস্টাইল, একজন ব্রেস্টফিডিং মায়ের সুস্বাস্থ্যের পথে এটি নানাভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন-

স্ট্রেস দূর করতেঃ যোগের কিছু চর্চা পিটুইটারি গ্রন্থিকে সচল রাখে এবং মায়ের স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। সেগুলো হল-

যোগাসনঃ

  • মার্জারী আসন – বিতিলাসন
  • বালাসন
  • বিপরীত করণী আসন

প্রাণায়ামঃ

  • সমবৃত্তি প্রাণায়াম
  • নাড়িশুদ্ধি
  • ভ্রমরী

মুদ্রাঃ

  • হৃদয় মুদ্রা
  • পদ্ম মুদ্রা
  • জ্ঞান মুদ্রা

কোমরে ব্যাথা দূর করতেঃ শিশুকে টানা বসে/শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের শরীর, বিশেষ করে কোমর ব্যথার কারণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে যোগের কিছু চর্চা সাহায্য করতে পারে। সেগুলো হল-

যোগাসনঃ

  • মার্জারী আসন – বিতিলাসন
  • ভুজঙ্গাসন
  • পর্বতাসন
  • সলভাসন
  • বালাসন

মুদ্রাঃ

  • কটি মুদ্রা

স্তনের আকৃতি ঠিক রাখতেঃ বাচ্চার জন্মের পর মায়েদের স্তনের আকৃতিতে পরিবর্তন আসে৷ অনেকের স্তন ঝুলে যায়। এ সমস্যা প্রতিরোধ করতে এবং স্তনের স্বাভাবিক আকৃতি ফিরিয়ে আনতে যোগের কিছু চর্চা বেশ কার্যকর। সেগুলো হল-

যোগসনঃ

  • ভুজঙ্গাসন
  • উষ্ট্রাসন
  • বৃক্ষাসন

এছাড়াও এসিডিটি, শারীরিক দূর্বলতা, মাথা ব্যথা, post-partum depression ইত্যাদি সমস্যাতেও ব্রেস্টফিডিং মায়েরা ভোগে এবং যোগের বেশ কিছু চর্চা এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে৷ তবে কেউ যদি নতুন যোগচর্চা করেন, অবশ্যই একজন সার্টিফাইড ইন্সট্রাক্টরের কাছে চর্চা করা উচিত।

শিশু যেন পর্যাপ্তভাবে মায়ের বুকের দুধ পায়, সেজন্য মায়ের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সে সাথে মাকেও বুঝতে হবে মা ও শিশু উভয়ের জন্য বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা, নিজের যত্ন নিতে হবে, সে সাথে সুস্থ থাকতে করতে হবে যোগচর্চা। আর সমাজের সবার দায়িত্ব হল বুকের দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সচেতনতা বাড়ানো। আমরা একটি সুস্থ ভবিষ্যত প্রজন্ম চাই, এবং তার জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নাই।

 

ফারিহা রশীদ

যোগ প্রশিক্ষক, হারমনি ট্রাস্ট

Facebook
Twitter
LinkedIn