মানবদেহের দ্বিতীয় বৃহত্তম অঙ্গ হলো লিভার বা যকৃত। কোন কোষের পাওয়ার হাউজ যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, ঠিক তেমনি মানবদেহের পাওয়ার হাউজ হলো লিভার। দেহের বেশিরভাগ কাজই সম্পাদিত হয় এই লিভারের মাধ্যমে, যেমন- প্রোটিন সিনথেসিস বা সংশ্লেষণ, বিপাকক্রিয়া, এনজাইম তৈরি, বাইল সিক্রেশন, রক্ত পরিশোধন ইত্যাদি। এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি কিন্তু আবার আমাদের নানাবিধ কারনেই অকেজো হয়ে যেতে পারে আর তখনই ঘটে নানা বিপত্তি। তাই এটিকে যেমন সুস্থ রাখতে হবে তেমনি এর যত্নও নিতে হবে আমাদের। আসুন আমরা জেনে নিই আমাদের ঘরে বা চারপাশে থাকা অতি পরিচিত কিছু খাবার দাবারের মাধ্যমে আমরা কিভাবে এই প্রয়োজনীয় অঙ্গটাকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে পারি।
১. হলুদ – হলুদে আছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি ফ্যাংগাল, অ্যান্টি ক্যান্সার উপাদান। হলুদের অ্যান্টি অক্সিডেন্ট লিভারকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করে এবং লিভারের ক্ষত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। এছাড়া লিভার থেকে দূষিত পদার্থ বের করে লিভারকে সুস্থ রাখে।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চা চামচ পরিমাণ হলুদের রস মধু বা দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
২. রসুন – রসুনে আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এছাড়া রসুনে বিদ্যমান এলিসিন ও সেলেনিয়াম লিভারের টক্সিন দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রসুন রক্তের চর্বি দূর করে হার্ট এর পাশাপাশি লিভারকে সুস্থ রাখতে কাজ করে।
দিনের যেকোন সময় ২/৩ কোয়া রসুন কাঁচা চিবিয়ে খান। তবে সকালে খালি পেটে খেলে বেশি ভালো হয়। রান্নার রসুনের চেয়ে কাঁচা রসুন এক্ষেত্রে বেশি উপকারী কারন তাপে রসুনে বিদ্যমান এলিসিন নামক উপাদানের গুণ নস্ট হয়ে যায়।
৩. সাইট্রাস ফুড/ লেবু জাতীয় ফল – ভিটামিন সি জাতীয় ফল যেমন- লেবু, আমলকী, জাম্বুরা ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে যা লিভার থেকে দূষিত পদার্থ দূর করে লিভারকে পরিস্কার রাখে। লেবুতে থাকা ডি লিমনেন নামক উপাদান লিভারের এনজাইমকে সক্রিয় করে তোলে ফলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।
প্রতিদিন লেবু পানি খান কারন হালকা গরম পানিতে লেবু মিশিয়ে খেলে চর্বি দূর হয় এবং দেহ ডিটক্সিফাই হয় অর্থাৎ দেহ থেকে দূষিত পদার্থ দূর হয়।
৪. গাজর – অ্যান্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর একটি সবজি গাজর। এটি লিভার থেকে টক্সিক পদার্থ দূর করে এবং রক্ত বিশুদ্ধ করে। গাজর নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার থেকে রক্ষা করে।
প্রতিদিন এক গ্লাস গাজরের জুস অথবা ২/৩ টি গাজর খান এবং লিভারকে সুস্থ রাখুন।
৫. টমেটো – টমেটোতে বিদ্যমান লাইকোপেন প্রস্টেট ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে লিভারের ক্ষতি হ্রাস করে।
টমেটো জুস বা তরকারি হিসেবে প্রতিদিন খাওয়া যায়।
৬. বীটরুট/ লাল বাঁধাকপি – বীটরুট এবং লাল বাঁধাকপি দুটোই লিভার থেকে দূষিত পদার্থ দূর করে লিভারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। রক্ত পরিশুদ্ধ করে। লাল বাঁধাকপিতে বিদ্যমান এন্থোসায়ানিন লিভারের এনজাইমকে সক্রিয় করে।
বীটরুট জুস করে এবং বাঁধাকপি সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া যায়।
৭. সবুজ শাকসবজি – পালংশাক, ব্রকলি, অঙ্কুরিত মুগ, বাঁধাকপি এবং ফুলকপিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ উপাদান এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এসব উপাদান কোলন থেকে দূষিত পদার্থ দূর করে এবং হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। একইভাবে চর্বি দূর করে লিভারকে সুস্থ এবং সক্রিয় থাকতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন এককাপ পরিমাণ সিদ্ধ সবুজ শাকসবজি খান এবং লিভারকে সতেজ রাখুন।
৮. আপেল – আপেল নিয়ে প্রবাদটা তো সবাই জানেন। হ্যাঁ, আপেল আমাদের অনেক উপকার করে। আপেলে থাকা পেক্টিন এবং ফাইবার হজমশক্তি বাড়ায় এবং রক্তের দূষিত পদার্থ দূর করে লিভারের সতেজতা বজায় রাখে। আর ম্যালিক এসিড লিভারের টক্সিসিটি দূর করে।
তাই লিভারের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন একটি আপেল খান। লাল বা সবুজ উভয়েই সমান গুন বিদ্যমান।
৯. কফি – কফি যেমন মনকে চাঙ্গা করে তেমনি লিভারকেও চাঙ্গা রাখে। প্রতিদিন এক কাপ ব্ল্যাক কফি লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
তবে অবশ্যই দুধ, চিনি ছাড়া কালো কফি পান করুন উপকার পেতে।
১০. সবুজ চা / গ্রীন টি – সবুজ চায়ে ক্যাটেচিন নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং পলিফেনল নামক উপাদান ফ্যাট দূর করে লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
প্রতিদিন এক / দুই কাপ সবুজ চা পান লিভারের জন্য ভালো।
১১. ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ – মাছের চর্বি বা ফ্যাট লিভারের জন্য বেশ উপকারী। মাছ থেকে প্রাপ্ত ওমেগা -৩ ফ্যাটি এসিড লিভার থেকে টক্সিন দূর করে এবং লিভারে অতিরিক্ত ফ্যাট জমতে বাঁধা দেয়।
তাই খাদ্য তালিকায় ওমেগা -৩ সমৃদ্ধ মাছ ( ইলিশ, টুনা, স্যামন) রাখার চেষ্টা করুন।
১২. বাদাম – সকল ধরনের বাদামই দেহের জন্য উপকারী বিশেষ করে হার্টের জন্য। তবে walnut বা আখরোট লিভারের জন্য বিশেষ উপকারী। এতে বিদ্যমান আর্জিনিন নামক এমাইনো এসিড লিভার থেকে এমোনিয়া দূর করে, লিভারে চর্বি জমতে বাঁধা দেয়। আর গ্লুটাথিয়ন লিভারের লিপিড প্রোফাইল উন্নত করে লিভারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন ৫-৭ টি আখরোট খান লিভারকে সুস্থ রাখতে।
১৩. ওটস্/ আস্ত শস্য দানা ( whole grain) – ওটস্ বা শস্য দানায় থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা হজম শক্তি বাড়ায়, লিভারে চর্বি জমতে বাঁধা দেয় এবং এনজাইমের ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া এসমস্ত খাবার ওজন কমাতে সাহায্য করে যা লিভারের সুস্থতার জন্য জরুরী।
প্রতিদিন সকালের নাস্তায় ওটস্ বা আস্ত শস্য দানা খাওয়ার অভ্যাস লিভার তথা পুরো দেহের জন্য ভালো।
১৪. অলিভ অয়েল – যদিও আমাদের দেশে রান্নায় অলিভ অয়েল ব্যবহারের প্রচলন নেই তবে এটি ব্যবহার করতে পারলে লিভার হার্টসহ অনেক অঙ্গকে সুস্থ রাখা সম্ভব। এতে বিদ্যমান ভিটামিন- ই এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড লিভারে ফ্যাট জমতে বাঁধা দেয়, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে এবং লিভারের টক্সিসিটি দূর করে।
তাই প্রতিদিন রান্নায় সয়াবিনের পরিবর্তে এই তেল ব্যবহার করা যায়। এছাড়া সালাদেও ব্যবহার করে উপকার পাওয়া যায়।
এতো গেল খাবারের ব্যাপার। শুধু খেলেই কি হবে, লিভার সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের খারাপ অভ্যাসের কারনে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তাই সুস্থ থাকতে হলে সকল প্রকার খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। যেমন –
১. ধূমপান না করা
২. অ্যালকোহল পান না করা
৩. অধিক রাত্রি না জাগা
৪. তেলেভাজা বা ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার না খাওয়া
৫. দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা কারন লিভারের সমস্যার জন্য অতিরিক্ত ওজন একটি বড় কারণ
৬. প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পানি পান করা।
সর্বোপরি, একটি সুস্থ জীবন বিধান মেনে চলা।
ফাতেমা নার্গিস
নির্বাহী কর্মকর্তা, মেডিসিনাল প্লান্টস & হারবাল প্রডাক্টস বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়