Harmony Trust

কেন আমি যোগ-ব্যায়াম করি

December 17, 2022

Five people on a beach stand in the warrior pose.

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে নিয়ম করে একসময় চার বন্ধু মিলে বিকেলে নদীর পাড়ে হাঁটতাম। তখন সাধারণ মানের একটা বই, সম্ভবত নীরদ সরকারের ’শরীর ও শক্তি’ হাতে পাই। সেটা পড়ে যোগ-ব্যায়াম করার আগ্রহ জাগে। কারো কাছ থেকে না শিখে বইটা পড়ে কয়েকটা আসন করা শুরু করেছিলাম। তার মধ্যে সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যাসন ও আরো দু’তিনটি আসন করতাম। কিছুদিন করার পর আমার শারীরিক অবস্থার দর্শনীয় উন্নতি ঘটে। তা দেখে এক বন্ধু কয়েকদিন আমার দেখাদেখি আসনগুলো অনুশীলন করলো। তারপর আসন করা বাদ দিয়ে অন্য বন্ধুদের সাথে গল্প করে বিকেলটা হাঁটাহাঁটি করা ভালো মনে করে যোগ-ব্যায়াম করা বাদ দিল। আমি দীর্ঘদিন এটা অনুশীলন করেছিলাম।


বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকরি করা, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া এবং বোধ করি কোনো ভালো গুরুর নিকট থেকে প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কারণেই নিয়মিত যোগ-ব্যায়াম করা হয়ে ওঠেনি। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকায় পিএইচডি করার সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে ডাক্তার বললেন তোমর ফুসফুস ঠিকই আছে, তবে এর ক্ষমতা বেশ কম। ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তিনি কোনো ওষুধ দেননি বা কোনো উপায় বলেননি। তার বছর দশেক পর শ্রীমৎ স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী রচিত ’যোগবলে রোগ আরোগ্য’ বইটা পড়ে যোগ-ব্যায়াম করার আগ্রহটা আবার জেগে ওঠে। বইটা পড়ে কয়েকটা আসন ও সকালে হাঁটার সময় ভ্রমণ প্রাণায়াম করতাম। এই প্রাণায়ামটা করার আগে আমার মনে হয়েছিল যে আমার ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়াতে প্রাণায়াম করাটা খুব কার্যকর হতে পারে। কয়েকমাস ধরে এটা অনুশীলন করার পর বুঝতে পারলাম আমার ফুসফুসের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। আগে আমি বেশিক্ষণ ধরে যেমন শ্বাস নিতে পারতাম না তেমনি বেশিক্ষণ ধরে শ্বাস ছাড়তেও পারতাম না। সেজন্য জন্মদিনের বেলুন ফোলাতে পারতাম না। ফুসফুসের ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার পর এক ফুঁ দিয়েই বেলুন ফোলাতে পারতাম।
চাকরিরত অবস্থায় একটা প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ২০০০ সালে ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যের কইমবাটোর ও মধ্যপ্রদেশের ভোপাল গিয়েছিলাম। কইমবাটোরে ভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক চিকিৎসার প্রথম কেন্দ্র ’আর কে ন্যাচার কিউর হোম’ অবস্থিত। সেখানে গিয়ে আমি হোমটির প্রতিষ্ঠাতা ৯৩ বছর বয়স্ক ড. আর কে কৃষ্ণস্বামীর সঙ্গে দেখা করলাম। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি পরদিন সকাল আটটার মধ্যে যেতে বললেন এবং সেখানে দুপুরে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। পরদিন সেখানে গেলে যোগ-ব্যায়াম ক্লাসে রোগীদের যেসব ব্যায়াম শেখানো হয় তা প্রথমে আমাকে দেখানো হলো। সেটা দেখার পর হোমের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন ক্লে থেরাপি, ম্যাগনেট থেরাপি, ওয়াটার থেরাপি প্রভৃতি ঘুরে ঘুরে দেখানো হলো। দুপুরে খাওয়ার জন্য সেখানে থাকা রোগীদের সাথে খেতে বসলাম। তাদের খাবার ছিল জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত সবজি, ডাল ও ভাত। বুঝলাম ওই কেন্দ্রে অসুস্থ মানুষ আসে কোনোরূপ ওষুধ ছাড়া যোগ-ব্যায়াম ও যথাযথ খাবার খেয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য।


ভোপালে প্রশিক্ষণের সময় একজন প্রশিক্ষক আমাকে গাঙ্গুলী-র ন্যাচার কিউর হোমে নিয়ে গেলেন। অভ্যর্থনাকারী আমাকে ডা. গাঙ্গুলীর ফোন নম্বর দিয়ে রাতে ফোন করতে বললেন এবং জানালেন যে তাঁর জন্ম ঢাকা জেলায় বলে ফোন করলে তিনি খুব খুশি হবেন। রাতে তাঁর সাথে টেলিফোনে কথা বললে তিনি তাঁর প্রশিক্ষণ ক্লাশে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। যে কয়দিন ভোপালে ছিলাম প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত দেড় ঘন্টা ধরে যোগ-ব্যায়াম অনুশীলন করতাম। দোতলা ভবনের অনেক বড় একটা হলে একসাথে দেড়শ নারী পুরুষ যোগ-ব্যায়াম করতেন। তখন ভারতে ওইটাই ছিল সবচেয়ে বড় যোগ-ব্যায়াম অনুশীলন কেন্দ্র। গুরুজী নামে খ্যাত ডা. গাঙ্গুলী একপাশে মাঝামাঝি স্থানে একটু উঁচু আসনে বসে নির্দেশনা দিতেন এবং যোগ-ব্যায়াম করে দেখাতেন। তাঁর সাথে সবাই একসাথে সেগুলো করতেন। প্রথমে প্রাণায়াম, তারপর ক্রিয়া ও আসন এবং সবশেষে ধ্যানের মাধ্যমে ক্লাস শেষ হতো।


গুরুজী ১৯৩৮ সালে দেশ ছেড়ে তাঁর দাদার কর্মস্থল মহারাষ্ট্রে যান এবং পরে ভোপালে স্থায়ী হন। বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার ইছাপুরা গ্রামে তাঁর ঠাকুরদাদা ইছাপুরা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ও তার প্রথম প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। গুরুজী নিজ জন্মস্থান দেখার প্রবল আগ্রহ দীর্ঘদিন ধরে পোষণ করছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশে কারোর সাথে যোগাযোগ না থাকায় দেখতে পারেননি। আমাকে ভোপালে পেয়ে তিনি তাঁর আগ্রহের কথা বলেন। আমি সানন্দে রাজি হলাম। কয়েক মাস পর তিনি তাঁর মেজ ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। পরদিন তাদেরকে নিয়ে আমি প্রথমে ইছাপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলাম। সেখানে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের ফটো টাঙানো ছিল। নিজ বাসভবন থেকে অত দূরের একটা গ্রামে ঠাকুরদাদার ছবি দেখে গুরুজী আনন্দে আপ্লুত হলেন। ফটোর দিকে তাকিয়ে তিনি ভক্তিভরে প্রণাম করে ঠাকুরদাদার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। পরে অন্যদের সহায়তায় তাঁর জন্মস্থানে নিয়ে গেলাম যেখানে তিনি তাঁর ছেলেকে অনেক স্মৃতিকথা শোনালেন। গুরুজীর বয়স তখন ৮২ বছর।
গুরুজী সপ্তাহ খানেকের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। যোগ শেখানো ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। তাঁর আগ্রহে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় যোগ-ব্যায়াম শিখতে ইচ্ছুক মহিলারা আসতেন শিখতে। আমার বাসায় প্রতিদিন আমি যেভাবে অনুশীলন করি তা ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলে তিনি তা দেখেছেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করার পরামর্শ দিয়েছেন যা আমার জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। তার পর থেকে আমি প্রতিদিন ভোরে যোগ-ব্যায়াম অনুশীলন করি। দেশে বা বিদেশে যেখানেই গিয়েছি এটা করা প্রায় কখনোই বাদ যায়নি। দাপ্তরিক কাজে বা অন্য কোনো কারণে কোথাও নিয়মিত সময়ের আগে বাসা থেকে রওনা করার প্রয়োজন হলে আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছি যাতে ব্যায়াম করা বাদ না যায়।


কোভিড ১৯ মহামারি শুরু হলে পত্রিকা পড়ে এবং পরিচিত আক্রান্তদের সাথে ফোনে কথা বলে বুঝেছিলাম যে এই ভাইরাসটি গলা, শ্বাসনালীগুলে এবং ফুসফুসের কোষে আঘাত করে করোনার কারখানা তৈরি করে। পরে ভাইরাসটি শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে আরো কোষকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। একজন সুস্থ ব্যক্তির রক্তে এর মাত্রা ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ থাকা উচিত। এই মাত্রা সহজে মাপা যায় অক্সিমিটার দিয়ে। এই মহামারিটা শুরু হওয়ার দশ বছর আগে আমার এক মামাত ভাই, যিনি নিজে ও স্ত্রী ডাক্তার, তার নিজের হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ভারত গেলে ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন যে তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম। আমি ফোনে শুনে বললাম যে আমি যোগ-ব্যায়ামের মাধ্যমে তার রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা নিশ্চিতভাবে বাড়িয়ে দিতে পারব। তাকে সাতদিন ধরে ব্যায়ামগুলো শিখিয়ে দিলাম এবং নিয়মিত অনুশীলন করতে বললাম, বিশেষভাবে প্রাণায়ামগুলো। বছরখানেক পর সেই ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করে বললেন অক্সিজেনের মাত্রা অনেক বেড়েছে।


মহামারিটা শুরু হলে অন্য প্রায় সকলের মতো সরকারি নির্দেশনাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতাম। তখন আমার মনে হয়েছিল আমি যেহেতু নিয়মিত যোগ-ব্যায়াম করি, বিশেষ করে প্রাণায়াম এবং আমার ফুসফুসের ক্ষমতা যেহেতু বেশ ভালো ভাইরাসটি বোধ করি আমাকে আক্রমণ করতে পারবে না। ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম কপালভাতি, অনুলোম বিলোম, ভ্রামরী ও উজ্জায়ী প্রাণায়াম করলে কোভিড ১৯ আক্রমণ করতে পারে না। আমি প্রতিদিন এই চারটা প্রাণায়াম দিয়ে ব্যায়াম অনুশীলন করা শুরু করি এবং ধ্যান করার পর শেষ করি, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে রোগটি আমাকে আক্রমণ করেনি।

ড. ক্ষীরোদ রায়

প্রাক্তন মহাপরিচালক

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট

Facebook
Twitter
LinkedIn